দুই ছেলের মৃত্যু, লড়ছেন মা-বাবা |
ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটে ছোট্ট জায়ানকে ক্লিনিক্যালি ডেড ঘোষণার পর কান্না ধরে রাখতে পারেননি স্বজনরা।
ভোরে ঘুম থেকে উঠেই চা পান করার অভ্যাস প্রকৌশলী শাহনেওয়াজের। তাঁর জন্য নিজ হাতে চা তৈরি করেন স্ত্রী সুমাইয়া বেগম। প্রতিদিনের মতো গতকাল শুক্রবার ভোরেও রান্নাঘরের গ্যাসের চুলায় চায়ের জন্য পানি গরম করতে যান তিনি। ১৪ মাস বয়সের ছেলে জায়ান বিন নেওয়াজকে কোলে নিয়ে স্ত্রীর কাজে সহায়তা করতে এগিয়ে যান শাহনেওয়াজও। সুমাইয়া চুলা জ্বালানোর জন্য দেশলাইয়ের কাঠি বের করে ঘষা দিতেই ঘটে বিস্ফোরণ। মুহূর্তে আগুনের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়ে পুরো ফ্ল্যাটে। ঝলসে যান সুমাইয়া। কোলের শিশুসন্তানসহ পুড়ে যান শাহনেওয়াজ। পাশের শোবার ঘরে ঘুমের মধ্যে দগ্ধ হয় তাঁদের আরো দুই ছেলে। পরে হাসপাতালে দুটি ছেলে মারা গেছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, আশঙ্কাজনক অবস্থায় আছেন শাহনেওয়াজ ও সুমাইয়া।
গতকাল রাজধানীর উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের ৩ নম্বর রোডের ৮ নম্বর বাড়ির সপ্তম তলায় ভোর সাড়ে ৬টার দিকে এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে। স্বজন ও প্রতিবেশীরা দগ্ধ পরিবারটিকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করেন। সেখানকার চিকিৎসকরা জানান, আগুনে শাহনেওয়াজের (৫০) শরীরের ৯৫ শতাংশ, সুমাইয়া বেগমের (৪০) ৯০ শতাংশ, তাঁদের বড় ছেলে সারলিন বিন নেওয়াজের (১৫) শরীরের ৮৮ শতাংশ, ছোট ছেলে জায়ান বিন নেওয়াজের (১৪ মাস) ৭৪ শতাংশ এবং মেজো ছেলে জারিফ বিন নেওয়াজের (১১) শরীরের ৬ শতাংশ পুড়ে গেছে। গতকাল সন্ধ্যা ৬টার দিকে বার্ন ইউনিটের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে সারলিনকে এবং পৌনে ৭টার দিকে শিশু জায়ানকে মৃত ঘোষণা করা হয়। শাহনেওয়াজ ও সুমাইয়া সেখানকার এইচডিইউ ওয়ার্ডে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। একমাত্র জারিফ শঙ্কামুক্ত। তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে এক আত্মীয়ের বাসায় নেওয়া হয়েছে।
স্বজনরা জানিয়েছেন, শাহনেওয়াজ যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের মেইনটেন্যান্স ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত। তাঁর স্ত্রী সুমাইয়া গৃহিণী। নিহত সারলিন উত্তরা রাজউক মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণির ছাত্র ছিল। তাদের গ্রামের বাড়ি ঝালকাঠিতে। স্বজনদের অভিযোগ, রান্নাঘরের গ্যাস সংযোগে ছিদ্র বা ত্রুটি থাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। কয়েক দিন আগে পরিবার নিয়ে এই বাসায় ওঠেন শাহনেওয়াজ। গ্যাস সংযোগে ত্রুটির বিষয়টি তিনি বাড়ির মালিককে জানালেও প্রতিকার হয়নি।
দগ্ধ প্রকৌশলী শাহনেওয়াজের বরাত দিয়ে স্বজনরা জানান, গতকাল খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে চা বানাতে যান সুমাইয়া। এ সময় জায়ানকে কোলে নিয়ে খাবারের ঘরে পায়চারি করছিলেন শাহনেওয়াজ। অন্য দুই ছেলে সারলিন ও জারিফ তাদের ঘরে ঘুমিয়েছিল। সুমাইয়া রান্নাঘরে গ্যাসের চুলায় আগুন ধরানোর জন্য দেশলাইয়ের কাঠি জ্বালানোর সঙ্গে সঙ্গে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। নিমেষে আগুনের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়ে তাঁদের ৮০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাটে। মুহূর্তের মধ্যে পুড়ে যায় সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে ভরা একটি সংসার। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নেভায়।
বার্ন ইউনিটে দগ্ধ শাহনেওয়াজ বলেন, নতুন ওই ভবনটিতে ওঠার পর গ্যাসের গন্ধ পাওয়া গেলে তিনি বিষয়টি বাড়িওয়ালা দেলোয়ার হোসেনকে জানান। পরে বাড়িওয়ালা একবার গ্যাসলাইন ঠিক করে দেন। এর পরও গন্ধ বের হচ্ছিল। কিন্তু কোথা থেকে গন্ধ বের হচ্ছিল তা তাঁরাও চিহ্নিত করতে পারেননি।
শাহনেওয়াজের প্রতিবেশী মনিরুজ্জামান বলেন, ভোর সাড়ে ৬টার দিকে প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ হয়। মনে হচ্ছিল ভূমিকম্প হচ্ছে বা বাড়িটি বোধ হয় ভেঙে পড়ছিল। ঘরের দরজা খুললে দেখা যায়, পাশের ফ্ল্যাটে আগুন ধরেছে। ছটফট করতে করতে ফ্ল্যাট থেকে লোকজন বের হয়ে আসেন। তাঁদের উদ্ধার করে প্রথমে পাশের একটি হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসা দিতে না পারায় অ্যাপোলো হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানেও সুরাহা না হলে শেষে নেওয়া হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে।
ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, ফ্ল্যাটটির দুটি কক্ষ, রান্নাঘর ও খাবার ঘর সবই ছিল ভস্মীভূত। বেশি পুড়েছে ফ্ল্যাটের পেছন দিকে থাকা রান্নাঘরটি। প্লাস্টিকের জিনিস ও দাহ্য বস্তু সবই পুড়ে গেছে। সব কক্ষের দেয়ালে লেগে ছিল পোড়া চামড়া।
বার্ন ইউনিটে শাহনেওয়াজের ফুপাতো বোন আরমিন নিশাত বলেন, “হাসপাতালে ছটফট করার সময়ও আমার ভাই বলছিল, ‘বাড়িওয়ালাকে গ্যাস লিক হওয়ার কথা বলেছিলাম।’ এত বড় একটি ঘটনা। পাঁচজন পুড়ে গেল! কিন্তু বাড়িওয়ালা একবারের জন্যও হাসপাতাল কিংবা ঘটনাস্থলে যায়নি।”
শাহনেওয়াজের ভাগ্নে নাজমুস সাকিব বলেন, বাড়িতে ওঠার পর গ্যাস জাতীয় গন্ধ ছড়ানোর বিষয়টি মামা বাড়িওয়ালাকে বলেছিলেন। গত বৃহস্পতিবারও একই অভিযোগ করা হয়।
এ অভিযোগের ব্যাপারে বক্তব্য জানার জন্য খোঁজ করা হলেও ভবনটির মালিক দেলোয়ার হোসেনকে পাওয়া যায়নি।
তবে বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক সালেহ বলেন, ‘এখানে প্রায়ই গ্যাস থাকে না। গ্যাস না থাকার বিষয়ে স্থানীয় তিতাস গ্যাস কার্যালয়ে একটি অভিযোগ দেওয়া হয়েছিল।’
ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের কর্মকর্তা আতিকুল আলম চৌধুরী বলেন, ‘গ্যাসের চুলা বন্ধ থাকলেও পাইপের কোনো অংশে হয়তো লিক ছিল। দীর্ঘ সময় ফ্ল্যাটের দরজা-জানালা বন্ধ ছিল। এ কারণে চুলা ধরাতে গিয়ে গ্যাসলাইনে বিস্ফোরণ ঘটে বলেই ধারণা করছি।’
উত্তরা পশ্চিম থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আবদুর রাজ্জাক বলেন, এ ঘটনায় আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ঘটনার কারণ সম্পর্কে বাড়িওয়ালাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
তবে বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক সালেহ বলেন, ‘এখানে প্রায়ই গ্যাস থাকে না। গ্যাস না থাকার বিষয়ে স্থানীয় তিতাস গ্যাস কার্যালয়ে একটি অভিযোগ দেওয়া হয়েছিল।’
ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের কর্মকর্তা আতিকুল আলম চৌধুরী বলেন, ‘গ্যাসের চুলা বন্ধ থাকলেও পাইপের কোনো অংশে হয়তো লিক ছিল। দীর্ঘ সময় ফ্ল্যাটের দরজা-জানালা বন্ধ ছিল। এ কারণে চুলা ধরাতে গিয়ে গ্যাসলাইনে বিস্ফোরণ ঘটে বলেই ধারণা করছি।’
উত্তরা পশ্চিম থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আবদুর রাজ্জাক বলেন, এ ঘটনায় আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ঘটনার কারণ সম্পর্কে বাড়িওয়ালাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
বার্ন ইউনিটের চিকিৎসক মুন্নী মমতাজ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘শাহনেওয়াজসহ চারজনেরই শ্বাসনালি পুড়ে গেছে। মেজো ছেলে (জারিফ) ছাড়া সবাইকেই সংকটাপন্ন হিসেবে চিকিৎসা দেওয়া হয়। দুজনের মৃত্যুর পর অন্য দুজনকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছি।’
দুর্বিষহ ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে শিশু জারিফ বলে, ‘আমি আর ভাইয়া ঘুমে ছিলাম। শব্দ আর গরমে ঘুম ভাঙে। দেখি শুধু আগুন আর আগুন। আগুনের মধ্যে দেখি ভাইয়া, আব্বু, আম্মু। আর কিছু মনে নাই...।’
গ্যাসের আগুনে ১৪ মাসে নিহত ২৪ : ঘটনাপ্রবাহ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, রাজধানীতে হরহামেশাই ঘটছে গ্যাসের সংযোগ ও চুলায় বিস্ফোরণ-অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। পুলিশ ও হাসপাতালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ১৪ মাসে রাজধানীতে গ্যাস সংযোগের আগুনে দগ্ধ হয়ে নারী, শিশুসহ ২৪ জন নিহত হয়েছে। এ সময়ে দেড় শতাধিক মানুষ গ্যাসের সংযোগ ও চুলার আকস্মিক বিস্ফোরণে দগ্ধ হয়েছে। ভুক্তভোগীসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুই বছর ধরে রাজধানীর আবাসিক গ্যাস সংযোগ ও চুলায় দুর্ঘটনা বেড়েছে। এসব দুর্ঘটনার প্রধান কারণ গ্যাসলাইনে ছিদ্র বা ত্রুটি। ঝুঁকিপূর্ণ অবৈধ সংযোগের কারণেও ঘটছে অগ্নিকাণ্ড। প্রাণহানিসহ অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি কখনোই।
আবাসিক সংযোগের ত্রুটিসহ সব বিষয় দেখার দায়িত্ব কর্তৃপক্ষ তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কম্পানি লিমিটেড। এ সংস্থাটির পরিচালক (অপারেশন) আলী আশরাফ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মূলত অসচেতনতার কারণেই এসব দুর্ঘটনা ঘটছে। আমরা রুল ফলো করেই সংযোগ দিই। গ্রাহকদের বলে দেওয়া হয়েছে গন্ধ বের হলে এটি ন্যাচারাল না। অথচ তারা লিকেজগুলো ধরে না।’ ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যাপারে প্রশ্ন করলে আলী আশরাফ বলেন, ‘ঢাকায় আমাদের ১২ লাখ গ্রাহক আছে। সবাইকে চেক করা সম্ভব নয়। তাই আমরা টিভি পত্রিকায় সচেতনাতামূলক প্রচার চালাই। এসব ঘটনা নিয়ন্ত্রণে এ প্রচার আরো বাড়ানোর কথা চিন্তা করছি।’
পুলিশ ও হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, গ্যাসের চুলার সংযোগ থেকেই বেশির ভাগ বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ড ঘটছে। গত বছরের ১১ অক্টোবর দক্ষিণখানের পূর্ব আশকোনায় একটি বাড়িতে রান্নাঘরের আগুনে পাঁচজন দগ্ধ হন, যাঁদের মধ্যে গৃহকর্মী সখিনা বেগম (৪২) এবং গৃহকর্ত্রী রেহেনা আক্তার (৪০) মারা যান। গত বছরেরই ২৬ সেপ্টেম্বর রাতে কাফরুলের পূর্ব সেনপাড়ায় ৫৯০ নম্বর টিনশেড বাড়িতে গ্যাসলাইনের বিস্ফোরণে একই পরিবারের ছয়জন দগ্ধ হন। পরে বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ৫ অক্টোবর গৃহকর্তা দেলোয়ার হোসেন (৫৫) এবং ৩ অক্টোবর তাঁর শিশু ছেলে জাহিদ (১৪) মারা যান। দেলোয়ারের স্ত্রী সালেহা বেগম বলেন, ‘চোরাই লাইনটা খারাপ অবস্থায় ছিল। ছিদ্র ছিল। মালিকরে বলার পরও সে ঠিক করে নাই। সবাই চোখের সামনে দেখছে এইটা।’ কাফরুল থানার ওসি সিকদার মুহাম্মদ শামীম হোসেন বলেন, ‘ঘরের সঙ্গে অবৈধ গ্যাসের লাইনটি ছিদ্র ও ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। এ কারণে আগুন ধরে। অভিযুক্ত বাড়িওয়ালা ওহিদ মিয়ার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে। তবে ঘটনার পর থেকে পালিয়ে গিয়ে জামিন নেয় সে।’
গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর বাসাবোর কদমতলায় ১ নম্বর সড়কের ৪ নম্বর বাড়ির গ্যাসের চুলা বিস্ফোরণে মাহমুদুল ইসলাম বনি (৩০) নামে এক যুবক নিহত হন। ১৮ আগস্ট ডেমরার সারুলিয়ার পশ্চিম বক্সনগরে দোতলা বাড়ির নিচতলায় গ্যাসের লাইনে বিস্ফোরণে আরিয়ান (১২) নামে এক শিশু নিহত হয়। ৩০ মে কলাবাগান লেক সার্কাস এলাকার একটি টিনশেড বাসায় গ্যাসলাইন বিস্ফোরণে সাতজন দগ্ধ হন। চার দিন পর বার্ন ইউনিটে মমতাজ বেগম (৬০) এবং ১২ দিন পর রোজিনা বেগম নামে দুই নারীর মৃত্যু হয়। গত ৮ আগস্ট কলাবাগানের সেন্ট্রাল রোডের ১১৪ নম্বর বাসায় গ্যাসলাইন বিস্ফোরণে নারীসহ তিনজন দগ্ধ হন। এক দিন পর সাদেকুন্নাহার পান্না আক্তার (২৮) হাসপাতালে মারা যান।
ঢামেকের বার্ন ইউনিটের আবাসিক সার্জন ডা. পার্থ শংকর পাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গ্যাসের আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। তাই বার্ন গভীর হয়। এতে প্রাণহানিও বেশি হয়। সচেতনতার অভাবেই চুলার বার্ন বেশি হয়ে থাকে।’
ডা. পার্থ শংকর বলেন, ‘গ্যাস বা চুলার আগুনে দগ্ধ রোগীর হিসাব আমরা মাসিকভাবে রাখি না। তবে এখানে চুলার আগুনের রোগীই বেশি। ঢাকার গ্যাসের সংযোগসংক্রান্ত রোগী বেড়েছে। এ বছর শতাধিক ঘটনা আমরা পেয়েছি।’
তবে হাসপাতালের নথিপত্র থেকে তথ্য পাওয়া গেছে, রাজধানীতে গত ১৪ মাসে দেড় শতাধিক মানুষ গ্যাসের সংযোগ ও চুলার আগুনে দগ্ধ হয়ে বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা নিয়েছে। সারা দেশে এ সংখ্যা আরো অনেক বেশি।
গত ১২ ফেব্রুয়ারি রামপুরায় গ্যাসের চুলার বিস্ফোরণে রাকিব হোসেন ও সরোয়ার সজীব নামে দুই কলেজ ছাত্র দগ্ধ হয়। একই দিন পল্লবীতে একটি ভবনের নিচতলায় আগুন লেগে একই পরিবারের পাঁচ নারী দগ্ধ হন। ৬ ফেব্রুয়ারি পশ্চিম ধানমণ্ডির ৮/এ সড়কের ২৮৫/২ নম্বর রওশান ডমইনো ভবনের নিচতলায় অগ্নিকাণ্ডে মুন্নুজান বেগম (৮০) ধোঁয়ায় শ্বাসরোধে মারা যান। একই দিন বংশাল আগামাসি লেনের ৯৭ নম্বর বাড়ির চতুর্থ তলায় গ্যাসের চুলার আগুনে পারভিন বেগম, দেলোয়ার হোসেন ও আবদুল মালেক নামে তিনজন দগ্ধ হন।
দুর্বিষহ ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে শিশু জারিফ বলে, ‘আমি আর ভাইয়া ঘুমে ছিলাম। শব্দ আর গরমে ঘুম ভাঙে। দেখি শুধু আগুন আর আগুন। আগুনের মধ্যে দেখি ভাইয়া, আব্বু, আম্মু। আর কিছু মনে নাই...।’
গ্যাসের আগুনে ১৪ মাসে নিহত ২৪ : ঘটনাপ্রবাহ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, রাজধানীতে হরহামেশাই ঘটছে গ্যাসের সংযোগ ও চুলায় বিস্ফোরণ-অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। পুলিশ ও হাসপাতালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ১৪ মাসে রাজধানীতে গ্যাস সংযোগের আগুনে দগ্ধ হয়ে নারী, শিশুসহ ২৪ জন নিহত হয়েছে। এ সময়ে দেড় শতাধিক মানুষ গ্যাসের সংযোগ ও চুলার আকস্মিক বিস্ফোরণে দগ্ধ হয়েছে। ভুক্তভোগীসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুই বছর ধরে রাজধানীর আবাসিক গ্যাস সংযোগ ও চুলায় দুর্ঘটনা বেড়েছে। এসব দুর্ঘটনার প্রধান কারণ গ্যাসলাইনে ছিদ্র বা ত্রুটি। ঝুঁকিপূর্ণ অবৈধ সংযোগের কারণেও ঘটছে অগ্নিকাণ্ড। প্রাণহানিসহ অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি কখনোই।
আবাসিক সংযোগের ত্রুটিসহ সব বিষয় দেখার দায়িত্ব কর্তৃপক্ষ তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কম্পানি লিমিটেড। এ সংস্থাটির পরিচালক (অপারেশন) আলী আশরাফ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মূলত অসচেতনতার কারণেই এসব দুর্ঘটনা ঘটছে। আমরা রুল ফলো করেই সংযোগ দিই। গ্রাহকদের বলে দেওয়া হয়েছে গন্ধ বের হলে এটি ন্যাচারাল না। অথচ তারা লিকেজগুলো ধরে না।’ ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যাপারে প্রশ্ন করলে আলী আশরাফ বলেন, ‘ঢাকায় আমাদের ১২ লাখ গ্রাহক আছে। সবাইকে চেক করা সম্ভব নয়। তাই আমরা টিভি পত্রিকায় সচেতনাতামূলক প্রচার চালাই। এসব ঘটনা নিয়ন্ত্রণে এ প্রচার আরো বাড়ানোর কথা চিন্তা করছি।’
পুলিশ ও হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, গ্যাসের চুলার সংযোগ থেকেই বেশির ভাগ বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ড ঘটছে। গত বছরের ১১ অক্টোবর দক্ষিণখানের পূর্ব আশকোনায় একটি বাড়িতে রান্নাঘরের আগুনে পাঁচজন দগ্ধ হন, যাঁদের মধ্যে গৃহকর্মী সখিনা বেগম (৪২) এবং গৃহকর্ত্রী রেহেনা আক্তার (৪০) মারা যান। গত বছরেরই ২৬ সেপ্টেম্বর রাতে কাফরুলের পূর্ব সেনপাড়ায় ৫৯০ নম্বর টিনশেড বাড়িতে গ্যাসলাইনের বিস্ফোরণে একই পরিবারের ছয়জন দগ্ধ হন। পরে বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ৫ অক্টোবর গৃহকর্তা দেলোয়ার হোসেন (৫৫) এবং ৩ অক্টোবর তাঁর শিশু ছেলে জাহিদ (১৪) মারা যান। দেলোয়ারের স্ত্রী সালেহা বেগম বলেন, ‘চোরাই লাইনটা খারাপ অবস্থায় ছিল। ছিদ্র ছিল। মালিকরে বলার পরও সে ঠিক করে নাই। সবাই চোখের সামনে দেখছে এইটা।’ কাফরুল থানার ওসি সিকদার মুহাম্মদ শামীম হোসেন বলেন, ‘ঘরের সঙ্গে অবৈধ গ্যাসের লাইনটি ছিদ্র ও ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। এ কারণে আগুন ধরে। অভিযুক্ত বাড়িওয়ালা ওহিদ মিয়ার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে। তবে ঘটনার পর থেকে পালিয়ে গিয়ে জামিন নেয় সে।’
গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর বাসাবোর কদমতলায় ১ নম্বর সড়কের ৪ নম্বর বাড়ির গ্যাসের চুলা বিস্ফোরণে মাহমুদুল ইসলাম বনি (৩০) নামে এক যুবক নিহত হন। ১৮ আগস্ট ডেমরার সারুলিয়ার পশ্চিম বক্সনগরে দোতলা বাড়ির নিচতলায় গ্যাসের লাইনে বিস্ফোরণে আরিয়ান (১২) নামে এক শিশু নিহত হয়। ৩০ মে কলাবাগান লেক সার্কাস এলাকার একটি টিনশেড বাসায় গ্যাসলাইন বিস্ফোরণে সাতজন দগ্ধ হন। চার দিন পর বার্ন ইউনিটে মমতাজ বেগম (৬০) এবং ১২ দিন পর রোজিনা বেগম নামে দুই নারীর মৃত্যু হয়। গত ৮ আগস্ট কলাবাগানের সেন্ট্রাল রোডের ১১৪ নম্বর বাসায় গ্যাসলাইন বিস্ফোরণে নারীসহ তিনজন দগ্ধ হন। এক দিন পর সাদেকুন্নাহার পান্না আক্তার (২৮) হাসপাতালে মারা যান।
ঢামেকের বার্ন ইউনিটের আবাসিক সার্জন ডা. পার্থ শংকর পাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গ্যাসের আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। তাই বার্ন গভীর হয়। এতে প্রাণহানিও বেশি হয়। সচেতনতার অভাবেই চুলার বার্ন বেশি হয়ে থাকে।’
ডা. পার্থ শংকর বলেন, ‘গ্যাস বা চুলার আগুনে দগ্ধ রোগীর হিসাব আমরা মাসিকভাবে রাখি না। তবে এখানে চুলার আগুনের রোগীই বেশি। ঢাকার গ্যাসের সংযোগসংক্রান্ত রোগী বেড়েছে। এ বছর শতাধিক ঘটনা আমরা পেয়েছি।’
তবে হাসপাতালের নথিপত্র থেকে তথ্য পাওয়া গেছে, রাজধানীতে গত ১৪ মাসে দেড় শতাধিক মানুষ গ্যাসের সংযোগ ও চুলার আগুনে দগ্ধ হয়ে বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা নিয়েছে। সারা দেশে এ সংখ্যা আরো অনেক বেশি।
গত ১২ ফেব্রুয়ারি রামপুরায় গ্যাসের চুলার বিস্ফোরণে রাকিব হোসেন ও সরোয়ার সজীব নামে দুই কলেজ ছাত্র দগ্ধ হয়। একই দিন পল্লবীতে একটি ভবনের নিচতলায় আগুন লেগে একই পরিবারের পাঁচ নারী দগ্ধ হন। ৬ ফেব্রুয়ারি পশ্চিম ধানমণ্ডির ৮/এ সড়কের ২৮৫/২ নম্বর রওশান ডমইনো ভবনের নিচতলায় অগ্নিকাণ্ডে মুন্নুজান বেগম (৮০) ধোঁয়ায় শ্বাসরোধে মারা যান। একই দিন বংশাল আগামাসি লেনের ৯৭ নম্বর বাড়ির চতুর্থ তলায় গ্যাসের চুলার আগুনে পারভিন বেগম, দেলোয়ার হোসেন ও আবদুল মালেক নামে তিনজন দগ্ধ হন।