Thursday, September 1, 2016

বদর নেতা মীর কাসেম আলী ও আলেকজান্ডারের শেষ ইচ্ছে

ফাঁসির দণ্ডের সামনে অপেক্ষা করছে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী ও আলবদর নেতা মীর কাসেম আলী। এখন তার রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা আবেদন করার পালা। বেঁচে থাকার শেষ ‘ছল’ হিসেবে মীর কাসেম আলী তার ‘নিখোঁজ’ ছেলেকে ছাড়া প্রাণভিক্ষার আবেদন বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত দেবেন না বলে জানিয়েছেন।

গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে বন্দী মীর কাসেমের সঙ্গে সাক্ষাতের পর তার স্ত্রী খন্দকার আয়েশা খাতুন সাংবাদিকদের এ তথ্য জানিয়েছেন। ‘নিখোঁজ’ ছেলের দেখা মিলুক আর না মিলুক, আইনের বিধান অনুযায়ী তাকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিতেই হবে। বিধান মতেই তাকে পরিণতির দিকে যেতে হবে।

একজন ক্ষুব্ধ পাঠক এসংক্রান্ত খবর পাঠ করে প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ১৯৭১-এ যাদের প্রাণনাশ বা প্রাণ সংহার আপনারা করেছিলেন, তাঁদের কোনো আকুতি কি আপনাদের কর্ণকুহরে পৌছেছিল ? তাদের কী আপনারা কোনো আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দেখা করার শেষ সুযোগ দিয়েছিলেন? তাহলে এখন কেন এই ছল?আসলে দুর্জনের ছলের অভাব হয় না। রাজাকার-আলবদর-যুদ্ধাপরাধীদেরও হয়নি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া চালানোর ক্ষেত্রে তারা যত ভাবে বিচারকে প্রলম্বিত, বাধাগ্রস্ত, প্রশ্নবিদ্ধ এমনকি বিচার প্রক্রিয়া বানচাল করা যায়, তার সবটুকুই অত্যন্ত সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে করেছে। কিন্তু কালক্ষেপণ ছাড়া অন্য কোনো ফল ফলেনি।

নানা দিক থেকেই মীর কাসেমের দণ্ড কার্যকর করাটা গুরুত্বপূর্ণ। তার যোগানো অর্থেই স্বাধীন বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী শক্ত ভিত্তি পায়। মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার বানচাল করতে এবং নিজে বিচার এড়াতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে প্রভাবশালী লবিস্টদের পেছনে হাজার কোটি টাকা ঢেলেছেন জামায়াতে ইসলামীর আর্থিক খাতের প্রাণভোমরা মীর কাসেম আলী।

২০১০ সালের প্রথমার্ধ থেকে ২০১২ সালের ১৭ জুন গ্রেপ্তার হওয়ার আগ পর্যন্ত এই বিপুল পরিমাণ অর্থ ঢেলেছেন তিনি। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি অর্থ দিয়েছেন তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী কনসালট্যান্সি ফার্ম কেসিডি অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসকে। ফার্মটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হলেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক কংগ্রেসম্যান মার্টি রুশো। মীর কাসেম আলী ২০১০ সালের ১০ মে প্রথম ছয় মাসের জন্য কেসিডির সঙ্গে চুক্তি করেছিলেন। ওই চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ২৫ মিলিয়ন ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৮২ কোটি টাকা) অগ্রিম পরিশোধ করতে হয়েছিল তাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের চোখ ফাঁকি দিয়ে সিটি ব্যাংক এনএর মাধ্যমে ইলেকট্রনিক ট্রান্সফার পদ্ধতিতে চুক্তির ওই অর্থ কেসিডি অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের হিসাব নম্বরে (৩০৭১৭২৪৮, সুইফট কোড : সিটি ইউএস ৩৩) পাঠানো হয়েছিল।

২০১২ সালের ২২ নভেম্বর সেন্ট লুইস পোস্ট-ডিসপাচ পত্রিকার অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, মার্কিন কংগ্রেস, যুক্তরাষ্ট্র সরকার এবং অন্যান্য দেশ যাতে মীর কাসেম আলীকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসে সেই চেষ্টাই করছিলেন হার্টলে। ‘মিসৌরিয়ান ইন কোয়েস্ট টু ফ্রি বাংলাদেশি নিউজপেপার ওনার ফ্রম জেল’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, গ্রেগ হার্টলে এরই মধ্যে মীর কাসেম আলীর পক্ষে মার্কিন কংগ্রেস, পররাষ্ট্র দপ্তর এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলোর কাছ থেকে যথেষ্ট সমর্থন জোগাড় করে ফেলেছেন। এ ছাড়া তার কম্পানি এ বিষয়ে সরাসরি আবেদন জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী (তখনকার) হিলারি ক্লিনটনের কাছেও। যুক্তরাজ্যেও লবিস্ট নিয়োগ করে মানবতাবিরোধী অপরাধীরা।

ব্রিটিশ আইনজীবী টবি ক্যাডম্যানকে জামায়াতীরা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে তাদের লিগ্যাল কনসালট্যান্ট বলে দাবি করলেও আইনি পরামর্শের বদলে তাকে অন্য কাজে ব্যস্ত দেখা যায়। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারপ্রক্রিয়া বানচাল করতে কিংবা নিদেনপক্ষে বিচারের হাত থেকে জামায়াত নেতাদের বাঁচাতে আন্তর্জাতিক লবিস্ট হিসেবে কাজ করেন তিনি। একই কাজ করেন স্টিভেন কে কিউসি নামের আরেক ব্যক্তি। জামায়াতের এই আন্তর্জাতিক লবিস্টরা বিভিন্ন টিভি, পত্রিকা, টক শো, জার্নালে বাংলাদেশের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের পক্ষে এবং বাংলাদেশের সরকার ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেয়। মধ্যপ্রাচ্যে এ কাজে তৎপর দেখা যায় সাবেক সৌদি কূটনীতিক ড. আলি আল-গামদিকে।

একসময় বাংলাদেশে সৌদি দূতাবাসে কর্মরত ছিলেন তিনি। গত কয়েক বছরে তিনি মাঝেমধ্যেই সৌদি গেজেটে লিখেছেন বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের বিরুদ্ধে। এ বিচার বন্ধ করার বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারকে চাপ দিতে ক্যাডম্যান সৌদি আরবের প্রভাবশালীদের প্রতি আহ্বানও জানান।

ড. কামাল হোসেনের জামাতা ডেভিড বার্গম্যানও জামায়াতি টাকায় যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে কাজ করেছেন বলে অভিযোগ আছে। দেশের ভেতরেও প্রভাবশালী মহলের কারো কারো বিরুদ্ধে মীর কাসেম আলীর বিচার বিলম্বিত করতে বিপুল পরিমাণ অর্থ নেওয়ার কথা প্রায়ই পত্রপত্রিকায় চাউর হয়েছে। কিন্তু কোনো কিছুতেই শেষ রক্ষা হলো না তার। এখন ফাঁসির দড়ি আর মীর কাসেম আলির মাঝখানে শুধু রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার আনুষ্ঠানিকতা বাকি। মানিকগঞ্জের হরিরামপুর থানার চালা গ্রামের পিডাব্লিউডি কর্মচারী তৈয়ব আলীর দ্বিতীয় ছেলে মীর কাসেম। ডাক নাম পিয়ারু। স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে পিতার চাকুরির সুবাদে চট্টগ্রাম গিয়েছিল পড়তে।

একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় চট্টগ্রাম জেলার সমস্ত রাজাকারী কর্মকাণ্ডের নাটের গুরু হয়ে উঠে সে। মীর কাশেমের নির্দেশে চট্টগ্রামের টেলিগ্রাফ অফিসের লাগোয়া ডালিম হোটেলে রাজাকার বাহিনীর বন্দি শিবির খোলা হয়। বহু লোককে ওখানে এনে খুন করা হয়। পানির বদলে অনেক বন্দীকে খাওয়ানো হতো প্রস্রাব। ১৭ ডিসেম্বর সেখান থেকে সাড়ে তিনশ বন্দীকে প্রায় মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। বুদ্ধিজীবি হত্যার তালিকা প্রণয়নকারীদের অন্যতম ছিল মীর কাশেম আলী।

জামায়াতের শীর্ষ পর্যায়ের এই নেতা ধনকুবের হয়েছেন মুক্তিযুদ্ধকালে ‘উদ্বাস্তু ও ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশি মুসলমানদের দুর্ভাগ্যের কাহিনি’ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ‘বিক্রি’ করে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সৌদি আরবে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা রাজাকার মুসলমানদের ক্ষয়ক্ষতি, মসজিদ-মাদ্রাসা ভেঙে ফেলার সাজানো কাহিনি বর্ণনা আর পাকিস্তানে আটকে পড়া বাংলাদেশি মুসলমানদের মানবেতর জীবনের কথা বলে তাদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য মধ্যপ্রাচ্য থেকে বিপুল অর্থ সহায়তা জোগাড় করেন তিনি।

আশির দশকে তিনি ছিলেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর আর্থিক সাহায্যপুষ্ট রাবেতা আলম আল-ইসলামী নামের এনজিওর কান্ট্রি ডিরেক্টর। রাবেতার নামে আসা অর্থেই মূলত তিনি একের পর এক গড়ে তোলেন ব্যবসায়িক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং এনজিও। দিগন্ত মিডিয়া, ইসলামী ব্যাংক, ইবনেসিনা ট্রাস্টসহ বহু আর্থিক, বাণিজ্যিক ও চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা ও পরিচালক বনে যান।

যে দেশের জন্মই চাননি, যে রাষ্ট্রের অভ্যুদয় পণ্ড করতে নির্মম হত্যাযজ্ঞে মেতেছিলেন একসময়; পরে সেই দেশের মাটিতে বেশ দাপটেই রাজনীতি করেছেন মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত এই আসামি। কাড়ি কাড়ি টাকার মালিক হয়েছেন বাংলাদেশে, তবু একাত্তরের ভুলের জন্য, অপরাধের জন্য কোনো দুঃখবোধ বা অনুশোচনা ছিল না। 

ভুল রাজনীতি ও ভ্রান্ত মতবাদের পেছনে ছুটে টাকার পাহাড় গড়েছেন, কিন্তু সেই টাকা তাকে ফাঁসির দড়ি থেকে রেহাই দেয়নি। তিনি এবং তার দলের নেতারা ভুলে গিয়েছিলেন যে, পাপ কখনও বাপকেও ছাড়ে না!পরিশেষে সম্রাট আলেকজান্ডারের শেষ ইচ্ছের কাহিনিটা উল্লেখ করা যাক। রাজ্যজয় সাঙ্গ হয়েছে, ভাণ্ডারে জমেছে বিপুল বৈভব। সুদূর ম্যাসিডোনিয়ার পথে ফেরার সময় বিশ্বজয়ী আলেকজান্ডার পড়লেন অসুখে। প্রাণঘাতী সে রোগ, ক্রমে শয্যা নিলেন, মৃত্যুর ছায়া ঘনাল শিয়রে। ঘরে ফেরা আর হল না বুঝি এ যাত্রায়।বয়সে যুবক, কিন্তু দেখেছেন, জেনেছেন অনেক।

অন্তিম কাল সমাসন্ন, আলেকজান্ডার বুঝতে পারলেন এই পরাক্রম, শৌর্য স্বর্ণসম্পদের অসারতা, জীবনের ক্ষণস্থায়িত্ব।কাছে দাঁড়িয়ে থাকা পাংশুমুখ সেনাপতিদের ডেকে বললেন, মরতে চলেছি আমি। ম্যাসিডোনিয়ার ভূমিস্পর্শ হয়তো আর সম্ভব নয়। তোমরা জেনে নাও আমার শেষ ইচ্ছেত্রয়। এক, আমার শববাহী কফিন যেন কেবল আমার ব্যক্তিগত চিকিৎসকরাই বহন করেন। অন্য কেউ নয়। দুই, যে পথে আমার মৃতদেহ যাবে, সে পথ যেন আমারই ভাণ্ডারের, আমারই অর্জিত রজতকাঞ্চনমুদ্রায়, মণিমঞ্জুষায় আবৃত থাকে। তিন, আমার মৃতদেহ কফিনের মধ্যে শায়িত রেখো, কেবল হাত দুটি ঝুলিয়ে দিও কফিনের বাইরে দুদিকে। শোকাকুল সেনাপতিদের এক জন আবেগে, বিনয়ে জিজ্ঞেস করলেন এই ইচ্ছাত্রয়ীর অর্থ। আলেকজান্ডার বললেনমৃত্যু অনিবার্য। মৃত্যু সত্য। কোনও চিকিৎসকই মৃত্যুকে পরাজিত করতে, অস্বীকার করতে পারেন না। মানুষ যেন তা বুঝতে পারে।দ্বিতীয়, ধনসম্পদে মুড়ে দেওয়া রাস্তা আমার গৌরবের চিহ্ন নয়। মানুষ জানুক, একটি কাঞ্চনমুদ্রাও সে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারবে না, পরপারে। আমার হাত দুটি ঝুলিয়ে রেখো কফিনের দুপাশে লোকে জানবে, আমি শূন্য হাতে এসেছিলাম পৃথিবীতে, যাচ্ছিও তাই।সাধে কী আর বলে, আলেকজান্ডার, দি গ্রেট!

মূলপাতা

আন্তর্জাতিক

এক্সক্লুসিভ