আজ ঐতিহাসিক ৭ নবেম্বর। মহান বিপ্লব ও সংহতি দিবস। এবারের দিবসটি এমন সময় পালন করা হচ্ছে, যখন বিরোধী জোটের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার চলছে, যখন বিদেশীসহ প্রতিনিয়ত মানুষ খুন হচ্ছে, যখন কোথাও কারো জীবনের নিরাপত্তা নেই, যখন সন্তান হারা পিতা তার খুন হওয়া ছেলের বিচার প্রত্যাশা করেন না, ঠিক এমন একটি বিভীষিকাময় সময়ে। দেশের ইতিহাসে দিবসটির তাৎপর্য থাকলেও ক্ষমতাসীন আ’লীগ বিএনপিকে সংহতি দিবসের সমাবেশের অনুমতিও দিচ্ছে না। দিবসটি তখনই পালন করা হচ্ছে যখন দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মন্দির ও বাড়িঘরে হামলা চালানো হচ্ছে। দিবসটি পালনের প্রাক্কালে বিএনপি চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াসহ দেশের অধিকাংশ রাজনীতিকদল ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা দেশের এ সংকটময় পরিস্থিতিতে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছেন। যদিও সরকার জাতীয় ঐক্যের এ আহবানকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে দেশের অধিকাংশ মানুষের চাওয়াকে অগ্রাহ্য করে চলেছে। একের পর এক মানুষ খুন হচ্ছে। শাসকদল খুনিদের গ্রেফতার না করে ঘটনা ঘটলেই বিরোধী দলের উপর দায় চাপিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা নিতে চায়। শত প্রতিকূলতার মধ্যেই বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ছাড়াও জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠন রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালনে বিস্তারিত কর্মসূচি নিয়েছে। এবারও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় সুদৃঢ় জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নব্য বাকশালী সরকার ও আধিপত্যবাদী অপশক্তি রুখতে সংকল্পবদ্ধ বিরোধী রাজনৈতিক জোট। বিএনপি চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া, জামায়াতে ইসলামীর আমীর মকবুল আহমাদ, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন দিবসটি উপলক্ষে পৃথক বাণী দিয়েছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এ দেশের মানুষ মনে করেন, স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ১৯৭৫ সালের ৭ নবেম্বর না হলে বাংলাদেশের ইতিহাস ভিন্নরকম হতে পারতো। এ জন্য যতোদিন স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ থাকবে, এর ইতিহাসে ৭ নবেম্বর একটি উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে থাকবে। রুশ-ভারতের অক্ষশক্তির চক্রান্তের বিরুদ্ধে স্বাধীন বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক জনগণ ও সশস্ত্র বাহিনীর অকুতোভয় সদস্যগণ গর্জে ওঠেছিল সেদিন। আজকে সংহতি দিবসের প্রেক্ষাপটেও সেই সিপাহী-জনতার অনন্য সাধারণ বিপ্লবের মতো স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে অভিন্ন প্ল্যাটফর্মের অটুট ঐক্য দরকার। এ সময়ে আরও দরকার বর্ণ চোরাদের ব্যাপারে সজাগ থাকা।
এমন এক সময়ে আজ বেসরকারিভাবে ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে দিবসটি পালন করা হচ্ছে যখন দেশে-বিদেশে প্রত্যাখ্যাত আওয়ামী সরকার জোর করে ক্ষমতা ধরে রেখেছে। তারা নিজেদের অবস্থানকে শক্ত করতে বিরোধী জোটের নেতাদের বিরুদ্ধে নতুন নতুন মামলা দিয়ে যাচ্ছে। নানাভাবে হয়রানি-নির্যাতন এবং মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করা হচ্ছে। বিরোধী জোটের সিনিয়র নেতাদের মিথ্যা অভিযোগে বিচারের নামে নির্বাচনে অযোগ্য করার আয়োজন করছে। বিএনপি-জামায়াতের সিনিয়র নেতাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। যেখানে মানবিক দিকটিও বিবেচনায় আনা হচ্ছেনা। জনসমর্থন না থাকায় তারা এখন ভিন্ন কৌশল নিয়েছে। বিরোধী জোটের আন্দোলন মোকাবিলায় অনেক আগেই সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করেছে। গুলী করে বিরোধী কণ্ঠ স্তব্ধ করতে চাচ্ছে। তারপরও রাজপথে রয়েছে বিরোধী ২০ দলীয় রাজনৈতিক জোট। তারা বলছে, অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে অবৈধ এ সরকারের বিদায় ঘটানো হবে। গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় তারা নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায়ে ঐক্যবদ্ধ। ৭৫-এর মতোই আবারো আধিপত্যবাদী অপশক্তি রুখতে সংকল্পবদ্ধ বিরোধী জোট।
প্রতি বছরই ৭ নবেম্বর পূর্বদিকে সূর্য ওঠে এবং পশ্চিম দিকে অস্ত যায়। তবুও যেন দিনটি আসে নবতর আবেদন নিয়ে। এ দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও জনগণের ভাগ্য নিয়ে যারা ছিনিমিনি খেলে তাদের রুখবার এ আবেদন কি কখনো পুরানো হবার? কর্নেল (অব.) শাফায়াত জামিলের ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নবেম্বর’ গ্রন্থে এ ভয়াবহ ও ষড়যন্ত্রের স্বরূপ তিনি নিজেই উন্মোচন করেছেন তার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। পঁচাত্তরের ৩ নবেম্বর কিভাবে সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমানকে পদত্যাগে বাধ্য করা হলো, কারা করলো, কিভাবে তাকে বন্দী করা হলো এবং পরিস্থিতি সামাল দেয়ার পর কিভাবে জিয়াকে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র করা হলো, কারা সহযোগিতা করলো, কারা করলো না, কিভাবে সিপাহী বিপ্লবের লিফলেট ছড়িয়ে পড়লো এবং কেন তারা ব্যর্থ হলেন। একজন অভ্যুত্থানকারী সাবেক সেনা কর্মকর্তা হিসেবে তিনি তার ভাষায় উক্ত গ্রন্থে তুলে ধরেছেন। তবে এ শে ৩ নবেম্বর থেকে ৭ নবেম্বর পর্যন্ত অরাজক পরিস্থিতির একটি বিবরণ পাওয়া যায়। আর তা থেকেই ৭ নবেম্বরের গুরুত্ব জাতির সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
কার্যত অক্টোবরেই অভ্যুত্থানের ষড়যন্ত্র চূড়ান্ত করা হয়। ৩ নবেম্বর থেকে সেনাবাহিনীতে শুরু হয় এক ভয়ানক আত্মঘাতী সংঘাত। সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমানকে বন্দী করে সংঘটিত হয় ব্যর্থ অভ্যুত্থান, ভেঙ্গে ফেলা হয় সেনাবাহিনীর ‘চেইন অব কমান্ড'। মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়া হয় অফিসার ও জওয়ানদের। এ সময় জেলখানার অভ্যন্তরে সংঘটিত হয় চার নেতা হত্যাকান্ড, প্রেসিডেন্টকে করা হয় ক্ষমতাচ্যুত, সংবিধান স্থগিত করে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি আবু সাদত মোহাম্মদ সায়েমকে করা হয় নতুন প্রেসিডেন্ট। জনপ্রশাসনে শুরু হয় চরম বিশৃঙ্খল অবস্থা। এ সময় দেশে জারি করা হয় সামরিক শাসন। জাতির ভবিষ্যৎ থেকে যায় অনিশ্চয়তার অন্ধকারে। জাতির এমনি এক ক্রান্তিলগ্নে ইথারে ভেসে আসে একটি ভাবগম্ভীর কণ্ঠস্বর- ‘প্রিয় দেশবাসী, আমি জেনারেল জিয়া বলছি...।’
একাত্তরের দিক নির্দেশনাহীন দিনগুলোর মতো আবার জিয়ার কণ্ঠস্বর শুনে জনগণ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। নাগরিকদের মনে পড়ে ৭ নবেম্বর সুবহে সাদিকের পর ঢাকার রাজপথে ট্যাংকের চাকার গর গর আওয়াজ ছাপিয়ে প্রকম্পিত হয়ে উঠা ‘নারায়ে তাকবীর- আল্লাহ আকবর’ ধ্বনির কথা। ট্যাংকের ওপর সেদিন অনেক উৎসাহিত জনতাকে লাফিয়ে ওঠে সেনাবাহিনীর সদস্যদের সাথে কোলাকুলি করতেও দেখা গেছে। সিপাহী-জনতার কণ্ঠে মুহুর্মুহু ধ্বনিত হয়েছে ‘সিপাহী-জনতা ঐক্য অমর হোক, জিন্দাবাদ', ‘সিপাহী-জনতা ঐক্য গড়ো, বাংলাদেশ রক্ষা করো।’ অতঃপর ৭ নবেম্বর প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমানকে ডেপুটি চীফ মার্শাল ল’ এডমিনিস্ট্রেটর নিয়োগ করেন। জেনারেল জিয়া দায়িত্বগ্রহণের পর প্রথমেই দক্ষতার সাথে সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। এভাবেই জিয়া বাংলাদেশীদের জন্য হয়ে ওঠেন ‘ত্রাণকর্তা’।
বিশিষ্ট সাংবাদিক-কলামিস্ট মরহুম সাদেক খানের ভাষায়- ‘১৯৭৫ সালের সিপাহী জনতার বিপ্লবের মধ্যদিয়ে প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশের সার্বভৌম মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সূচনা হয়।’ প্রসঙ্গত, ৬ নবেম্বর কর্নেল তাহেরের নির্দেশে সেনাবাহিনীতে ছড়িয়ে পড়ে ‘সিপাহী বিপ্লব ’ শিরোনামে একটি লিফলেট। ফলে মুক্তিযোদ্ধা ও জাসদ সমর্থিত সিপাহীরা দ্রুততার মধ্যে ঐক্যবদ্ধ হতে সমর্থ হয়। ঐক্যবদ্ধ সিপাহী-জনতা ছিনিয়ে আনে ৭ নবেম্বরের সাফল্যের বিজয়গাঁথা।