একে একে নিয়ে আসা হচ্ছে চার শিশুর মরদেহ। বাহুবলের সুন্দ্রাটিকি গ্রামের এই চার শিশু গত শুক্রবার বাড়ির পাশে মাঠে খেলতে যাওয়ার পর থেকে নিখোঁজ ছিল। গতকাল সকালে তাদের লাশ উদ্ধারের পর নিয়ে যাওয়া হচ্ছে l ছবি: আনিস মাহমুদ* বাহুবলের গ্রাম থেকে পাঁচ দিন আগে নিখোঁজ
* খুনিদের ধরতে পুরস্কার ঘোষণা
একটি নয়, দুটি নয়; চার চারটি শিশুকে মেরে বালুচাপা দিয়ে রাখা হয়েছে। ওদের তিনজন পরস্পর চাচাতো ভাই এবং একই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র। অন্যজন তাদের প্রতিবেশী ও মাদ্রাসার ছাত্র। গ্রামের মাঠে খেলতে গিয়ে তারা নিখোঁজ হয় পাঁচ দিন আগে। এই কদিন পরিবারের লোকেরা তাদের খুঁজে বেড়িয়েছেন। থানা-পুলিশ করেছেন। বুকে আশা নিয়ে সন্তানদের জন্য অপেক্ষা করেছেন মা-বাবারা।
কিন্তু গতকাল বুধবার তাঁদের সেই আশা ধূলিসাৎ হয়ে যায়। প্রিয় সন্তানদের লাশ উদ্ধার হয় বাড়ি থেকে এক কিলোমিটার দূরে গ্রামের এক ছড়া (ছোট নদী) থেকে। হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার সুন্দ্রাটিকি গ্রামে শিশুদের পরিবারে শুরু হয় মাতম। বিস্ময়ে, শোকে স্তব্ধ পুরো গ্রামের মানুষ।
বর্বরতার শিকার শিশুরা হলো মো. ওয়াহিদ মিয়ার ছেলে জাকারিয়া আহমেদ (৯), আবদুল আজিজের ছেলে তাজেল মিয়া (১০), আবদাল মিয়ার ছেলে মনির (৭) ও আবদুল কাদিরের ছেলে ইসমাইল হোসেন (৮)। জাকারিয়া, তাজেল ও মনির সম্পর্কে আপন চাচাতো ভাই। তিনজনই সুন্দ্রাটিকি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ইসমাইল গ্রামের ইসলামিয়া কওমি মাদ্রাসার প্রথম শ্রেণির ছাত্র। পরিবারগুলো খেটে খাওয়া, কৃষিজীবী।চার শিশুর লাশ উদ্ধার করে গতকাল সুন্দ্রাটিকি গ্রামে তাদের বাড়িতে নেওয়া হলে কান্নায় ভেঙে পড়েন স্বজনেরা l প্রথম আলো
এই নিষ্ঠুরতার কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না কেউ। তবে নিহত শিশুগুলোর পরিবার ও স্থানীয় লোকজন খুঁজে পেতে যে কারণটাকে সন্দেহের মধ্যে রাখছেন, তা গ্রাম পঞ্চায়েতের বিরোধ। তবে বড়দের বিরোধের কারণে শিশুদের প্রতি এ বর্বরতাও যেন মেলাতে পারেন না তাঁরা।
ঘটনাকে ‘লোমহর্ষক’ উল্লেখ করে সিলেট অঞ্চলের পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) হত্যাকারীদের তথ্যদাতার জন্য এক লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছেন। গতকাল রাত সাড়ে আটটার দিকে গ্রামের আবদুল আলী ও জুয়েল মিয়া নামের দুই যুবককে আটক করে বাহুবল থানার পুলিশ।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত লোকজন ও পুলিশের তথ্যমতে, গতকাল সকাল আটটার দিকে বালু উত্তোলনকারী শ্রমিক কাজল মিয়া ও আরও তিন–চারজন শ্রমিক গ্রামের পাশে কামাইছড়ায় বালু তুলতে যান। এ সময় কাজল মিয়ার নাকে দুর্গন্ধ লাগে। কৌতূহল নিয়ে বালুর একটি টেকের (জমানো বালু) কাছে গিয়ে দেখেন, একটি শিশু আধা বালুচাপা দেওয়া অবস্থায় পড়ে আছে। এ দৃশ্য দেখে তিনি দৌড়ে যান নিখোঁজ তাজেলের বাবা আবদুল আজিজের কাছে। সুন্দ্রাটিকি থেকে এক কিলোমিটার দূরের কামাইছড়ায় শিশুর লাশ দেখার কথা জানান আজিজকে। ঘটনাস্থলে ছুটে যান নিখোঁজ পরিবারের সদস্যরা। আবদুল আজিজ পরনের প্যান্ট ও শার্ট দেখে ছেলে তাজেলকে শনাক্ত করেন। বালুশ্রমিক কাজল মিয়া বলেন, ‘মুখ দেখে চেনার উপায় ছিল না। গলে গেছে।’
বাতাসের বেগে খবর ছড়িয়ে পড়ে গ্রামে। খবর দেওয়া হয় বাহুবল থানায়। ওসি মোশারফ হোসেনের নেতৃত্বে পুলিশ বেলা ১১টায় ঘটনাস্থলে এসে গ্রামবাসীর সহযোগিতায় তাজেলের লাশের পাশ থেকে বালু তুলে একে একে আরও তিনটি লাশ উদ্ধার করে। শোকে মুহ্যমান অভিভাবকেরা সন্তানদের শনাক্ত করেন। শত শত লোক ঘটনাস্থলে জড়ো হয়। সেখানে এক হৃদয়বিদারক পরিস্থিতি তৈরি হয়।
পুলিশ ও শিশুদের পরিবার সূত্রে জানা গেছে, নিহত শিশুরা গত শুক্রবার বিকেলে বাড়ির পাশে একটি মাঠে খেলাধুলা করছিল। পরে গ্রামের পাশে পূর্ব ভাদেশ্বর গ্রামে ফুটবল খেলা দেখতে যায়। তবে মাঠে বৃষ্টির পানি জমে থাকায় ওই দিন খেলা হয়নি। সন্ধ্যার পর শিশুরা বাড়িতে না ফেরায় অভিভাবকেরা আশপাশে খুঁজতে থাকেন। এলাকায় মাইকিং করা হয়। গত শনিবার রাতে শিশু জাকারিয়ার বাবা ওয়াহিদ মিয়া বাহুবল থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন।
.নিহত শিশু মনিরের বাবা আবদেল মিয়া বলেন, ‘প্রথম দিকে পুলিশ তেমন গুরুত্ব দেয়নি। ঘটনার চার দিন পর আমাদের থানায় ডেকে নিয়ে বলে অপহরণ মামলা দিতে।’
নিহত তাজেলের বাবা কৃষক আবদুল আজিজের অভিযোগ, ‘ছেলেদের পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। পুলিশকে আমরা সব বলেছি কারা ঘটনা ঘটাতে পারে। পুলিশ বিষয়টিকে কোনো গুরুত্বই দেয়নি। গত রোববার পুলিশ আমাদের বাড়িতে আসে, ওসি তখন বলেন, “আল্লাহকে ডাকেন, মিলাদ-তজবিহ পড়েন।”’
তবে বাহুবল থানার ওসি মোশারফ হোসেন দাবি করেন, শুরু থেকেই তাঁরা পরিবারগুলোকে সহযোগিতা করেছেন।
গতকাল লাশ উদ্ধারের পর পুলিশের সিলেট বিভাগের ডিআইজি মিজানুর রহমান, হবিগঞ্জের পুলিশ সুপার জয়দেব কুমার ভদ্র, র্যা ব-৯-এর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ও সিআইডির তদন্ত দলের সদস্যরা ঘটনাস্থলে আসেন। বেলা একটার দিকে লাশগুলো নিয়ে যাওয়া হয় বাহুবল মডেল থানায়। সেখান থেকে পরে ময়নাতদন্তের জন্য নেওয়া হয় হবিগঞ্জ সদর জেলা আধুনিক হাসপাতালে।
সুরতহালের বিষয়ে জানতে চাইলে বাহুবল মডেল থানার ওসি (তদন্ত) আবদুর রহমান জানান, বাহ্যিক আঘাতের চিহ্ন তাঁরা পাননি। কারণ লাশগুলো পচে গলে গেছে।
তবে ময়নাতদন্তের পর হবিগঞ্জ জেলা আধুনিক হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা আবু নাঈম মাহমুদ হাসান বলেন, শিশুদের শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে। সবার শরীরে অনেক আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। তাদের হাড়ও ভাঙা পাওয়া গেছে।
নিহত ইসমাইলের বাড়িতে গিয়ে জানা যায়, ছেলের লাশ পাওয়ার খবর শুনে মা মিনারা বেগম জ্ঞান হারিয়ে আছড়ে পড়েন বাড়ির উঠানে। ইসমাইলের বাবা আবদুল কাদির তাঁকে নিয়ে বাহুবল উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গেছেন। আত্মীয়স্বজন বাড়িতে বসে আছেন।
নিহত তাজেলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় ঘরের সামনে অসংখ্য মানুষ ও স্বজনদের ভিড়। বাঁশের পাটির একচালা ঘর। ঘরের ভেতরে ঢুকেই দেখা গেল তাজেলের মা আমেনা বেগমকে ঘিরে বসে আছেন বাড়ির আরও কিছু নারী। কাঁদছেন না, কেবল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন আমেনা।
তাজেলদের ঘরের সামনের ঘরটি জাকারিয়া ও মনিরদের। জাকারিয়ার মা বানু আক্তার, মনিরের মা সোলেমা আক্তার চিৎকার করে বারবার ছুটে যেতে চান লাশের কাছে। জাকারিয়ার মা বারবার বলছেন, ‘আমার ছেলে কই? আমার বুকের ধনকে ফিরিয়ে দেও। আমার এ সর্বনাশ কে করল গো?’
এ প্রশ্নের উত্তর নেই গ্রামটির কারও কাছেই। গ্রামের রফিক আলী বলেন, সব সময় ছেলেরা গ্রামের ভেতরে খেলাধুলা করে। এর মধ্যে এত বড় অঘটন ঘটবে কে জানে। মনে হয় গ্রামের ভেতরেই ঘাতকেরা আছে।
নিহত শিশুদের পরিবারসহ গ্রামবাসী জানান, গ্রামটি পঞ্চায়েতনিয়ন্ত্রিত। সম্প্রতি পঞ্চায়েতের নেতৃত্বে দুটি ভাগ হয়েছিল। পঞ্চায়েতের এক অংশের নেতৃত্বদানকারী একজন নিহত তিন শিশুর আত্মীয়।
তবে নিহত মনিরের বাবা আবদাল মিয়া সাংবাদিকদের বলেন, ‘বরইগাছ কাটাকে কেন্দ্র করে প্রতিবেশীদের সঙ্গে তাঁর বচসা হয়েছিল। পঞ্চায়েত বিষয়টি নিষ্পত্তি করে দেয়।’
পুলিশের সিলেট বিভাগের ডিআইজি মো. মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, প্রাথমিক তদন্তে পঞ্চায়েতবিরোধের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
গ্রামের বাসিন্দা ফয়জাবাদ হাইস্কুলের শিক্ষক হুমায়ুন কবির বলেন, ‘গ্রামে গোষ্ঠীগত কিছু সমস্যা আছে। তবে বড়দের দ্বন্দ্বে শিশুরা প্রাণ হারাতে পারে, এমনটি বিশ্বাস করতে পারছি না।’
গতকাল সন্ধ্যায় জানাজা শেষে সুন্দ্রাটিকি গ্রামের কবরস্থানে চার শিশুকে পাশাপাশি দাফন করা হয়। আশপাশের কয়েক গ্রামের শত শত মানুষ জানাজায় অংশ নেন।