হবিগঞ্জের বাহুবলে ৪ শিশুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সুন্দ্রাটিকি গ্রামে শুনসান নিরবতা বিরাজ করছে। থামছে না নিহতদের পরিবারের সদস্যদের আহাজারি। শান্তনা দিতে নিহতদের বাড়িতে ভিড় করছেন স্বজনরা।
এই হত্যাকান্ডের ঘটনায় ২ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আরও ২জনকে আটক করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃতদের দুপুরে আদালতে সোপর্দ করা হবে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
এদিকে, হবিগঞ্জ সিভিল সার্জন দেবপদ রায় জানান, চার শিশুর ময়না তদন্তের রিপোর্ট চূড়ান্ত করা হয়েছে। তাদের শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, বৃহস্পতিবার সকালে পুলিশের একাধিক টিম সুন্দ্রাটিকি গ্রামটিতে ঢুকে। অপরদিকে যাদের বিরুদ্ধে এ ঘটনার অভিযোগ, সে বাড়িতে কোন পুরুষ নেই। রয়েছেন কয়েকজন মহিলা। তারা দাবি করেন, হত্যাকাণ্ডের সাথে তাদের কোন সম্পৃক্ততা নেই।
শোকের ছায়া সুন্দ্রাটিকি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েও। সহপাঠীদের হারিয়ে নীরব নিস্তব্ধ অন্যরা। যেখানে আগে ৪ থেকে সাড়ে ৪শ শিক্ষার্থী ক্লাসে আসতো, সেখানে আজ আসছে মাত্র ৩০/৩৫ জন শিক্ষার্থী। শিক্ষকরাও মর্মাহত, শোকাহত। তাদের মাঝেও রয়েছে আতঙ্ক।
সুন্দ্রাটিকি গ্রামের মানুষের মাঝে অজানা আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। অনেকেই ভয়ে কথা বলতে চাইছেন না। তবে ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন গ্রামবাসী।
চার শিশু প্রসঙ্গে কথা বলতে গেলে গ্রামবাসীর সবার চোখে পানি এসে যায়। অনেকেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। কারা এমন পাষণ্ড, এত বড় হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পারে? এ প্রশ্ন সবার মাঝেই ঘুরপাক খাচ্ছে। সবার বক্তব্য একটাই, যদি তাদের মুরুব্বীদের মাঝে বিরোধ থেকে থাকে, তাহলে এর শিকার শিশুরা কেন হবে? শিশুদের তো কোন অন্যায় ছিলনা!
যে স্থানটি থেকে ৪টি লাশ উদ্ধার করা হলো সেখান থেকে প্রতিদিনই বালু উত্তোলন করে শ্রমিকরা। গত ৬ দিন ধরে সেখানে কোন শ্রমিক যায়নি। কিন্তু সোমবারও পুলিশসহ গ্রামবাসী সেখানে তাদের খুঁজতে গিয়েছিল। তখনও তারা তেমন কিছু দেখেনি। তা হলে কখন এসব শিশুদের মাটি চাপা দিয়েছিল হত্যাকারীরা? গ্রামের ভেতর দিয়ে কীভাবে-ইবা তাদের লাশ নিয়ে গেল, যে কারও চোখে পড়েনি! কেউ একটু শব্দও পায়নি! এত শত প্রশ্ন সবার।
এ ব্যাপারে গ্রামের তালুকদার গোষ্ঠীর নেতা অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক আব্দুল খালেক জানান, তারা ভাবতেও পারেন না তাদের গ্রামেই এত বড় নির্মম ঘটনা ঘটেছে। কেন প্রতিপক্ষ মুরুব্বীদের বিরোধের জন্য অবুঝ শিশুদের হত্যা করলো? তারা মারতে হয় মুরুব্বীদেরই মারতো।
কেন আব্দুল আলী বাঘালকেই তারা এ ঘটনার জন্য দায়ি করছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তারা হুমকি দিয়েছে। বলেছে, আমার জীবনে অনেক পাপ করেছি। এবার শেষ আরেকটি পাপ করে মাপ চেয়ে নেব। এও বলেছে, আমার ছেলেরা উচ্ছৃঙ্খল। তারা কখন কাকে মারে ঠিক নেই। তাছাড়া ঘটনার পর থেকে বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজার হাজার মানুষ আমাদের বাড়ি এলেও তারা কেউ একবারও আসেনি। এমনকি লাশ উদ্ধারের পরও তারা আসেনি। খবর নেয়নি। এসব কারণেই আমরা সন্দেহ করছি, তারাই ঘটনাটি ঘটিয়েছে।
অভিযোগ অস্বীকার করেছেন আব্দুল আলী বাঘালের স্ত্রী আলেমা বেগম ও মেয়ে খেলা বেগম। তারা জানান, কোন অবস্থাতেই তাদের পরিবারের কেউ এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয়। তারাও এ হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করেন।
সুন্দ্রাটিকি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা নূরে জান্নাত শেফা জানান, স্কুলের প্রতিটি শিশুই আমার সন্তানের মতো। আমার সন্তানের কিছু হলে যে কষ্ট পাই, তেমনই লাগছে। ঘটনার আগের দিনও স্কুলে ৪ থেকে সাড়ে ৪শ’ শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে এসেছে। কিন্তু এখন আসে মাত্র ৩০/৩৫ জন।
তিনি বলেন, আতঙ্কে অভিভাবকরা শিশুদের স্কুলে দিতে চাননা। ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। যদি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়, তবে আর কেউ এমন ঘটনা ঘটানোর সাহস পাবেনা।
সহকারি পুলিশ সুপার (হবিগঞ্জ সদর) মাসুদুর রহমান মনির জানান, ২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদেরকে দুপুরে আদালতে প্রেরণ করা হবে। এ ঘটনায় যে অপহরণ মামলা হয়েছে তাই নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মামলায় রূপান্তরিত হবে।